ফলোআপ: আল জাজিরার চাঞ্চল্যকর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সম্প্রচার বন্ধে রিট, সরকারের তদন্ত না করার রহস্য নিয়ে গুঞ্জন
।। সুরমা প্রতিবেদন ।।
লণ্ডন, ১২ ফেব্রুয়ারী – বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরার “অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টার‘স মেন” শিরোনামের চাঞ্চল্যকর অনুসন্ধানী প্রচারের দুই সপ্তাহ অতিবাহিত হতে চলেছে। প্রতিবেদনটি প্রচারের পরপর দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন। এখনও এবিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা অব্যাহত রয়েছে। প্রতিবেদনটি প্রচারিত হবার বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি কীভাবে দেখে এবং উত্থাপিত অভিযোগগুলোরই ব্যাপারে সরকারের জবাব কী হয়— তা-ই ছিলো মূখ্য বিষয়। কিন্তু দেখা গেলো যে, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কিছু বিভাগ একটি ডকুমেন্টারে জবাবে তথাকথিত রাজনৈতিক বক্তব্যই দিয়ে যাচ্ছে। সরকার এবং তার সমর্থকরা আল-জাজিরার এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনকে কোনো ধরণের তদন্ত ছাড়াই ষড়যন্ত্র এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কারসাজি বলে দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে দেশের সাধারণ মানুষসহ সচেতন মহলে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানকে জড়িয়ে এতোবড় একটি ডকুমেন্টারিতে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর সরকারের তরফ থেকে তদন্ত করার কোনো ঘোষণা না করার রহস্য নিয়ে গুঞ্জন চলছে।
উল্লেখ্য, গত ১ ফেব্রুয়ারী, সোমবার বৃটেন সময় রাত ৮টায় আল-জাজিরাতে “অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টার‘স মেন” প্রচারিত হবার পর বাংলাদেশ ও বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশীসহ বিশ্বজনমে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ডক্যুমেন্টারিতে উত্থাপিত অভিযোগগুলো কি সত্য নাকি মিথ্যা? মিথ্যা হলে কীভাবে বা কিসের ভিত্তিতে মিথ্যা সরকারের পক্ষ তা বিষয়টির প্রামাণিক জবাব দেওয়ায় অধিকাংশ মানুষকে হতাশ করছে। ডক্যুমেন্টারিতে প্রচারিত সাথে সরকারের পরারাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এর পক্ষ থেকে পৃথক পৃথক বিবৃতি দিয়ে বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ষড়যন্ত্রমূলক দাবী করলেও এসম্পর্কে কোনো ধরণের তদন্তের ঘোষণা দেয়া হয়নি। আর এতে করে জনমনে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। অনেকেরই প্রশ্ন বিষয়টির তদন্ত করে সঠিক জবাব না দিতে পারলে দেশের যে ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে সেটির পুনরুদ্ধার হবে কীভাবে?
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের মিডিয়া জগতেও দুধরণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একদল ডিজিটাল আইনসহ সরকারী
নানা ধমন-পীড়নের ভয়ে মুখ না খোলার আভাস এবং অপরপক্ষ সরকারের ন্যায় কোনো ধরণের তদন্ত বা প্রমাণ ছাড়াই আল-জাজিরার প্রতিবেদনকে অপপ্রচার আখ্যায়িত করা হীন প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক৭টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা জাতিসংঘকে এ বিষয়ে জাতিসংঘের নিজস্ব পদ্ধতিতে যে তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছে।
এদিকে, আল-জাজিরায় প্রচারিত প্রতিবেদনটি জাতিসংঘকে তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। বুধবার বিকালে দলের চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আল জাজিরার প্রতিবেদনে সরকারপ্রধানের পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কতিপয় কর্মকর্তা ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে তথ্য প্রমাণসহ নানান দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারি সব প্রতিবাদ বিবৃতিতে প্রতিবেদনে উল্লেখিত অভিযোগগুলোর সুনির্দিষ্ট জবাব না দিয়ে রাজনৈতিক বুলির আড়ালে অভিযোগগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকেও অপরাধ আড়ালের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করার হীন প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিও সরকারের ওইসব বক্তবের গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যার দাবি জানিয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়।
এছাড়া সচেতন মহলের অনেক গুণীজন সরকারের ধামাচাপা দেওয়ার বিষয় বুঝতে পেরে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন আল-জাজিরাকে মিথ্যে প্রমাণ করুন। তাদের মতে, সেনাপ্রধানের ভাইদের কাজকর্ম এবং তাদের সাথে উনার যোগাযোগ নিয়ে আল-জাজিরার সচিত্র প্রতিবেদন বহু মানুষ দেখেছে, দেখছে। এর উত্তরে সরকারীভাবে দুটো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এসবে আল-জাজিরার প্রতিবেদনে পরিবেশিত তথ্যের উত্তর তেমনভাবে নাই। আছে প্রতিবেদনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ। বলা হচ্ছে আল-জাজিরার প্রতিবেদন অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রমূলক।
এটি যে অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রমূলক তা আমরাও বিশ্বাস করতে চাই। কিন্তু এজন্য প্রতিবেদনে পরিবেশিত বিষয়গুলোর উপযুক্ত উত্তর দেশবাসীকে জানানো দরকার।
এদিকে, বাংলাদেশে আল জাজিরার স¤প্রচার বন্ধের আবেদনের প্রেক্ষিতে আইনজীবীদের মতামত জানতে চেয়েছে আদালত। আল জাজিরার স¤প্রচার বন্ধের রিট আবেদনটি বিবেচনার যোগ্য কি-না তা নির্ধারণে ছয়জন অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত। এই ছয়জন অ্যামিকাস কিউরি এ বিষয়ে আদালতকে পরামর্শ দেবেন। এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ১৫ ফেব্রুয়ারী পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে ঢাকার গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রতিবেদন প্রচারের পর বাংলাদেশে আল জাজিরার স¤প্রচার বন্ধের আদেশ চেয়ে ৮ ফেব্রুয়ারী সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী এনামুল কবির ইমনের হাইকোর্টে দায়ের করা এক রিট আবেদনের প্রেক্ষাপটে বুধবার এ আদেশ দিয়েছে আদালত। রিটে বাংলাদেশে আল জাজিরার স¤প্রচার বন্ধের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ‘অল ‘দ্য প্রাইম মিনিস্টার‘স মেন’ নামে স¤প্রচারিত প্রতিবেদনটি ইউটিউব, ফেইসবুক ও টুইটার থেকে অপসারণের নির্দেশনাও চাওয়া হয়। বুধবার আদালত যে ছয়জন অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দিয়েছে, তারা হচ্ছেন এজে মোহাম্মদ আলী, আব্দুল মতিন খসরু, শাহদীন মালিক, ফিদা এম কামাল, প্রবীর নিয়োগী এবং কামাল উল আলম।