আল জাজিরার প্রতিবেদন: দুঃশাসন ও অপরাজনীতির হার্ড ইমিউনিটি
ডক্টর এম মুজিবুর রহমান
এক:
আল জাজিরাতে প্রকাশিত ‘অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টার্স ম্যান’ শীর্ষক প্রতিবেদন নিয়ে বিস্তর আলাপ আলোচনা চলছে। এই আলোচনাকে তিনটি ধারায় ব্যাখ্যা করা যায়। এক পক্ষ বলছেন এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে বাংলাদেশের বর্তমান গুম, খুন, দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অপশাসন যে রাষ্ট্রীয় মদদে ঘটে থাকে তার একটা বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। অন্যপক্ষ প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু সম্পর্কে কোনো জবাব না দিয়ে চিরাচরিত পন্থায় আল জাজিরা কি, কে পরিচালনা করে, কোথা থেকে পরিচালিত হয় ইত্যাদি সম্পর্কে খেই হারানোর মতো বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। এখানে তৃতীয় আরেকটি পক্ষ রয়েছেন। তবে সেই পক্ষকে আবার তিনটি উপধারায় ভাগ করা যায় । তাদের এক পক্ষ যারা নিরপেক্ষ ও সুশীল সেজে ক্ষমতাসীনদের সুবিধাভোগী হয়ে কাজ করেন, তাদের বক্তব্য হলো এই প্রতিবেদন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কোনো মানদন্ডে পরে না । তবে তাদের মিডিয়া বা আলোচনাতে এসব বিষয়ের অবতারণা কেন করতে পারেন না, তা নিয়ে তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না।
অপর পক্ষের যুক্তি হলো তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বিভিন্ন খড়গের কারণে অনেক কিছু বলতে পারছেন না, তবে নিজেদের অবস্থানকে কোনোমতে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রতিবেদনের কিছু ঘাটতি নিয়ে আলোচনা করার ছলে ইশারা ইঙ্গিতে প্রতিবেদনটির বক্তব্য প্রচার করতে চাইছেন। আরেক পক্ষ রয়েছেন যারা এই প্রতিবেদনটিকে গুম, খুন, দুর্নীতি, দুঃশাসন ও অপরাজনীতির বাস্তব প্রেক্ষাপটে এতে প্রকাশিত তথ্যাদি ‘কিছুই না’ এ ধরণের একটা ভাব প্রকাশ করছেন। এটা প্রায় সকল সেক্টরে দুর্নীতি ও অরাজকতা দেখে চরম হতাশা ও ক্ষোভ থেকেও কেউ কেউ এরকম মন্তব্য করতে পারেন বলে মনে হয় । এছাড়া রাষ্ট্রীয় মদদে কোনো অপরাধের অভিযোগ অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে ভিন্ন মাত্রা দেয়। কারণ রাষ্ট্রীয় মদদে অপরাধ সংগঠিত হলে এতে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে পরে।
মোটাদাগে বলা যায় প্রতিবেদন তৈরিতে কারা জড়িত ছিলেন তা না খোঁজে প্রকাশিত অভিযোগ বা তথ্য নিয়ে কথা বলা হলে জনমনে এর স্বচ্ছতা পরিষ্কার হতো । আইনের শাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে সাংবাদিকের কাজ হলো গ্লাসের অর্ধেক ভর্তি দেখানো নয় বরং অর্ধেক গ্লাস খালি তা তুলে ধরা। মিডিয়ার কাজ হলো অন্যায় অবিচারকে তদন্তের আওতায় নিয়ে আসা । দায়িত্বশীলদের কাজ হলো তা তদন্ত করে অভিযোগ বা অপরাধের সঠিক তথ্য বের করে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা। তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে গণমাধ্যমে কোনোকিছু প্রকাশিত হলে জনমনে সাধারণ একটা উপলব্দি তৈরী হয়ে যায়। যা একমাত্র স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে দূরীভূত করা সম্ভব। রাজনৈতিক রেটোরিক বক্তব্য এক্ষেত্রে খুবই বেমানান।
প্রথমে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় উপস্থাপক হানিফ সংকেতের বহুল প্রচারিত ইত্যাদি অনুষ্ঠানের একটি নাট্যাংশের অংশ স্মরণ করা যেতে পারে। ওখানে দেখা যায় একজন লোক টাকা তুলার জন্য ব্যাংকে যান। গিয়ে দেখেন তার পাশের একজন ‘পাঁচ লক্ষ টাকা মাত্র’ লিখে চেক দিয়ে টাকা তুলছেন। লোকটি একটু চিন্তায় পরে গেলেন। ভাবলেন পাঁচ লক্ষ টাকা ‘মাত্র’ হলে পাঁচ হাজার টাকাতো ‘কিছুই না’। তাই তিনি চেকে ‘পাঁচ হাজার টাকা কিছুই না’ লিখে যথারীতি টাকা তুলতে কাউন্টারে গেলেন। ক্যাশিয়ার উনার দিকে এমন একটা ভাব নিয়ে তাকালেন মনে হলো লোকটিকে গিলে খাবে। ভদ্রলোক যেন কিছুই হয় নি এইরকম ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ভাই, আপনি আমাকে টাকা না দিয়ে এরকম তাকিয়ে আছেন কেন? তখন ক্যাশিয়ার একটু ব্যঙ্গ করে বললেন, আপনার বাড়ি পাবনা থেকে কতদূর? কথা হলো আপনি নিজে কি মনে করলেন তা নিয়ে সবকিছু হয় না। সবকিছুর একটা স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম-কানুন আছে। শৃঙ্খলা ও সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে তা মানা বাঞ্চনীয়। অনেকেই মানতে চায় না। সেটা ভিন্ন। তার জন্য রাষ্ট্রীয় আইন কানুন প্রয়োগ হবে তা হতে পারে না । এই যে, কিছুই না এটা ভয়ঙ্কর। তবে অনিয়মের পাহাড়ে সবকিছুর প্রকোপে, ব্যকটেরিয়া বা ভাইরাসের মতো এতে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ বা ‘সহনীয়’ একটা ভাব যে চলে আসে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। নিজের ক্ষমতা ঠিকিয়ে রাখতে অসংখ্য অন্যায় অবিচারকে প্রশ্রয় দিলে একটা সার্বভৌম দেশের অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পরে।
আড্ডায় বা কথার ফাঁকে অনেক কিছু নিয়ে আলাপ আলোচনা হয় । একটা লম্বা আলোচনার পর উপসংহার জানতে চাইলে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন যে, দেশ খুব একটা দূরে নয় মাত্র অসভ্যতা থেকে একটা স্বরবর্ণ ‘অ’ কে অতিক্রম করতে পারলে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। তাই একটা ‘অ’ কে সরাতে বিভিন্ন দেশের মানুষকে শত শত বছর পার করতে হয়েছে এবং এখনো সত্য ও সুন্দরকে গ্রহণ করতে অনবরত চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের দেশেই কত সুন্দর গানের কলি রয়েছে, ‘মোরা একটা ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ব করি, মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি’ এটাই সভ্যতা আর এটাই মানবতা।
দুই:
বিশ্বময় করোনা মহামারীর কারণে কয়েকটি নতুন শব্দের সাথে বিশ্ববাসী পরিচিত হয়েছে। তার মধ্যে যেমন লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, হার্ড ইমিউনিটি। হার্ড ইমিউনিটি বলতে বুঝানো হয়েছে যে, একটা অঞ্চলের বেশিরভাগ লোক যখন করোনাতে আক্রান্ত হয়ে তাদের শরীরে এন্টিবডি তৈরী হয়ে যায় তখন মহামারী নিয়ন্ত্রণে আসতে সাহায্য করে। আমরা বোধ হয় প্রতিনিয়ত গুম, খুন, অন্যায় অনাচার দেখতে দেখতে হার্ড ইমিউনিটির দিকে ধাবিত হচ্ছি তা হয়তো অস্বীকার করার উপায় নাই।
সুবিধাবাদী চিন্তার পরিবর্তন দেখে সত্তর দশকে মহাত্মা আহমদ ছফা ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ বলে একটি বিখ্যাত গ্রন্থ লিখেছিলেন । বর্তমানে অসংখ্য রাজনৈতিক দল আছে নির্বাচনও হচ্ছে। কিন্তু ভোট, গণতন্ত্র আইনের শাসন নিয়ে দেশ বিদেশে অভিযোগ রয়েছে । অনেকের অভিযোগ দেশের মানুষ নিজেদের ভোটটা পর্যন্ত দিতে পারছে না কিন্তু যথারীতি নির্বাচন হচ্ছে । কিন্তু এ নিয়ে তেমন শক্ত কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখা যায় না । আবার অসংখ্য গণমাধ্যম আছে কিন্তু চিন্তার সাহসী মানুষের অভাব রয়েছে । অর্থ্যাৎ সবকিছুর উপস্থিতি আছে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কিছুই নেই। এটাও বর্তমান সরকারের বিরাট এক জাতিগত উন্নয়ন নয় কি? আল জাজিরার প্রতিবেদনের পর এই হার্ড ইমিউনিটি তৈরির যে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তা নিয়ে বিস্তর গবেষণার দাবি রাখে । সাহসী চিন্তা ও অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন লেখক আহমদ ছফা বেঁচে থাকলে এ ধরণের সমষ্টিগত অবক্ষয় এবং আমাদের জাতিগত পরিচয় নিয়ে হয়তো বিশদ ব্যাখ্যা দিতে পারতেন । তবে কোনো দেশে তেল আর ঘি একদামে পাওয়া গেলে সেখানে যে ন্যায়বিচার পাওয়া যায় না তার লক্ষণ দেখা যায়। এই হার্ড ইমিউনিটির কারণে অনেক বড় বড় অপরাধকে তুচ্ছ মনে হওয়ার একটা কারণ থাকতে পারে বটে। তাই এ নিয়ে মহাত্মা আহমদ ছফার ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ জাতীয় গবেষণার মাধ্যমে আমাদের জাতিস্বত্তা নিয়ে বিস্তর বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। তখন হয়তো এর সমাধানের পথও খোঁজা যেতে পারে।
অনেকের মতে কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমদের জনপ্রিয়তার অন্যতম একটা কারণ হলো যে, তিনি সমাজের অতি সাধারণ বিষয়কে সাহিত্যকর্মের শৈল্পিকতা ও অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সর্ব সাধারণের মনে দাগ কাটতে পারতেন । জনপ্রিয় উপস্থাপক হানিফ সংকেত ইত্যাদি অনুষ্ঠানে সমাজের অন্যায় ও অসঙ্গতিকে শৈল্পিকভাবে প্রকাশ করতে পারেন। প্রতিদিন হয়তো সকলেই এসব কিছু দেখে থাকেন কিন্তু হার্ড ইমিউনিটির কারণে মনে দাগ কাটেনা। কিন্তু শৈল্পিক উপস্থাপনের মাধ্যমে অনেকের অন্তর্দৃষ্টি খোলে বলে তখন এসব ঘটনা দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। সাধারণ জনগণের মনের ভাষায় কথা বলতে পারা শিল্পীর সবচেয়ে বড় স্বার্থকতা। রাষ্ট্র ও সমাজে অহরহ ঘটে যাওয়া অনিয়মের ঘটনাকেও সঠিক তথ্য প্রমানের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে পারলে সাধারণ মানুষের মনে রেখাপাত তৈরী করে। আল জাজিরার প্রতিবেদন তার উজ্জ্বল উদাহরণ। হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির রেটোরিক প্রকাশ আর তথ্য উপাত্ত দিয়ে দুর্নীতির প্রকাশ ভিন্ন মাত্রা দিয়ে থাকে । প্রতিবেদনে প্রকাশিত কিছু বিষয় নিয়ে ইউনাইটেড নেশন থেকে তদন্তের আহবান আল জাজিরার প্রতিবেদনের কি প্রভাব তা সহজেই অনুমান করা যায়।
বড় বড় অন্যায় হয় কিন্তু দালিলিক প্রমানের অভাব এবং রাষ্ট্রীয় শক্তির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে হয়তো অনেক কিছু সামনে আসে না। এছাড়া রাষ্ট্রীয় মদদে অপকর্ম ও অন্যায় আর ব্যক্তির অন্যায় সমান বিষয় নয়। তাই যারা সমাজ পরিবর্তনের কথা বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেন তাদের উচিত অন্যায়কে অন্যায় হিসেবে দেখা । দেশের দুর্নীতি, দুঃশাসন সর্বোপরি অপরাজনীতি নিয়ে সাধারণ একটা পার্সেপশন রয়েছে। এই পার্সেপশনকে বদলাতে হলে তথ্য উপাত্ত নিয়ে যারা এগিয়ে আসেন তাদেরকে স্বাগত জানাতে হবে। অন্যথায় এই অবস্থার পরিবর্তন অসম্ভব। কেউ ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। একটা আলখেল্লা লাগিয়ে নিজের আখের গোছাতে আমরা সবাই সিদ্বহস্ত কিন্তু দিনশেষে সবাই যে ভুক্তভোগী তা বুঝে আসে না অথবা সাময়িক স্বার্থের মোহে বুঝতে চাই না। তাই দু’য়ে দু’য়ে চার, দুই তিনি নয় – এ আর কি বিস্ময় বলে দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে চলে না। কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হয়। নিজে ভোগ করতে পারবো না এই বলে পরবর্তী প্রজন্মকে অন্ধকারে রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে নগর পুড়লে দেবালয় রক্ষা পায় না।
তাই করোনার মহামারী থেকে রক্ষা পেতে হার্ড ইমিউনিটি কাম্য কিন্তু গুম, খুন, দূর্নীতি, দুঃশাসন ও অপরাজনীতির মহামারী থেকে হার্ড ইমিউনিটি কাম্য হতে পারে না। আল জাজিরার অনুসন্ধান নিয়ে দেশের অনেক গণমাধ্যমের নীরবতা বা একপেশে ব্যাখ্যা জাতিগত চরম অবক্ষয় নয় বলে এখনো বিশ্বাস করতে চাই । পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করার স্বার্থে রাষ্ট্র ও সমাজে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখা সময়ের দাবি।
লন্ডন, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২১।