ডাক্তার সৈয়দ আবু হাসান: স্মৃতিগাঁথা কিছু কথা
।। সৈয়দ ছাবির আহমদ ।।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী।
১৯৭৭ সাল। বয়স তখন বারো। সৈয়দপুর শামছিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায় দাখিল ১ম শ্রেণীতে পড়ি। সে সময় ঊনিশ বছরের টগবগে সুদর্শন এক যুবক সুদূর মালেশিয়া থেকে সরকারি স্কলারশিপ নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পড়তে আসেন। ক্লাস শুরু হতে মাত্র আরো কয়েক সপ্তাহ বাকি তাই এই ফাঁকে দাদী ও আত্মীয় স্বজনদের দেখতে বেড়াতে এসেছেন সৈয়দপুর পশ্চিম পাড়া দাদীর বাড়িতে। মূলত বাড়িটি আমাদের বাপ চাচাদেরই, কিন্তু ঐ বাড়িতে দাদী থাকতেন বলে দাদীর বাড়ি বলতাম। তাঁর আগমনের সংবাদ পেয়ে মাগরিব নামাজের পর বড় ভাই সাহেবের সাথে সেখানে গেলাম। দেখা সাক্ষাত পরিচয় হল। তখন যদিও আমি একজন অপরিপক্ক ছোট মানুষ। কিন্তু খুব একটা অবুঝ ও ছিলাম না, অনেক কিছুই আঁচ করতে পারতাম। তাই তাঁকে দেখা মাত্র প্রথম দর্শনেই মনে হয়েছে তাঁর চোখে মুখে যেন সাফল্যের চুড়ান্ত সোপানে আরোহণ করার এক প্রদীপ্ত স্বপ্ন বিরাজ করছে। এই যুবকটিই ছিলেন আজ পরলোকগত আমার চাচাতো ভাই ডাক্তার সৈয়দ আবু হাসান।
ঐ রাত দাদীর বাড়িতে আমি থেকেছি কিনা মনে নেই। তবে পরের দিন দুপুরে খাবার খেয়ে সৈয়দপুর বাজারে একসাথে গিয়েছিলাম বিষয়টা মনে আছে। বাজারে আমার চাচাদের একটি কাপড়ের দোকান ও ‘বন্ধু লাইব্রেরি’ নামে একটি বই কিতাবের লাইব্রেরি ছিল। উভয় দোকানেই বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলে প্রায় সারাদিন কাটিয়েছি। বিদেশি নতুন মেহমান হিসেবে কিছুক্ষণ পরপর চা-কেক-বিস্কুট খেতে দেয়া হত, যা আমার কাছে ছিল বেশ উপভোগ্য। এমনিতেই চা-কেক এর প্রতি আমার যথেষ্ট আসক্তি ছিল। যে আসক্তি এখন ও রয়েছে, স্বাস্থ্য পরিপন্থী হওয়া সত্যেও জীবনের এই পরিণত বয়সে এসে ও কমাতে পারিনি। আমার মনে হয় এটা আমাদের পারিবারিক জেনেটিক সমস্যা ও হতে পারে। মরহুম আব্বা হযরতকেও দেখেছি ডায়াবেটিস সত্যেও চা-কেক-বিস্কুট-ব্রেড ইত্যাদি তাঁর বেশ প্রিয় ছিল। মালয়েশিয়ার চাচা ও বহুদিন যাবৎ ডায়াবেটিস রোগে ভুক্তভোগী ছিলেন। কিন্তু মিষ্টান্ন জাতীয় খাবার পরিত্যাগ করতে পারেননি। তাই বলছিলাম ঐদিন বাজারে আবু হাসান ভাইয়ের সামনে যতবার চা নাস্তা রাখা হয়েছে ততবার তিনি না খেলেও আমি কিন্তু সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করিনি, বারবার খেয়েছি যতবার পেয়েছি।
প্রথম দিকে আবু হাসান ভাই বাংলা বলতে পারতেন না বিধায় কেউ বুঝুক আর না বুঝুক সবার সাথে ইংরেজীতে কথা বলতেন। যারা ইংরেজী ভাষার অন্তত কিছু শব্দ ও জানত তারা বেশ কিউরিসিটি নিয়ে তাঁর সাথে কথা বলত এবং তাদের ভাঙা ভাঙা শব্দগুলোর দ্বারাই তাদের উদ্দিষ্ট কথা অনেকটা বুঝে নিতেন। আমার ক্ষেত্রে ও এমনটাই হয়েছিল। দু’ একটা শব্দ বললেই তিনি পুরোটা বুঝে নিতে পারতেন। তখন জানতামই বা আর কতটুকু। মাত্র পঞ্চম শ্রেণী শেষ করে আলিয়া মাদ্রাসায় দাখিল ১ম শ্রেণীতে পড়ছিলাম। তবে আমাদের পরিবারের সকলের ইন্টারপ্রিটার ছিলেন আমাদের দাদী। তিনি মালয়েশিয়ান ভাষা বেশ ভালই জানতেন। কারণ তাঁর ছেলে মরহুম আবুল ফজল চাচার সাথে হজ্জ থেকে ফেরার পথে একাধারে তিন বছর তিনি মালয়েশিয়া ছিলেন। সেজন্য গ্রামে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে অধিকাংশ সময় তিনি তাঁর সঙ্গে থাকতেন। ছুটি কাটিয়ে আবু হাসান ভাই চলে যান মেডিক্যাল কলেজ ঢাকায়। পড়াশোনার ব্যস্ততা হেতু গ্রামে খুব একটা আসা হত না। তারপরও সময় সুযোগ করে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আত্মীয় স্বজনদের বিশেষ করে দাদীকে দেখতে মাঝে মধ্যে আসতেন। এছাড়া বিশেষ কোন প্রয়োজন দেখা দিলেও আসতেন। বড় ভাই হাফিজ সৈয়দ ইমামুদ্দীন আহমদ সাহেবের বিয়ে উপলক্ষে মেজো ভাই সৈয়দ নূর আহমদ তাঁকে সিলেট মেডিক্যাল কলেজ থেকে নিয়ে এসেছিলেন। বিয়েতে আমার খালাতো ভাই ইংল্যান্ড প্রবাসী সৈয়দ জুবের আহমদ সাহেব ও ছিলেন। যিনি বাল্যকাল থেকে বিলেতে বসবাস করায় ইংরেজী ভাষা ছিল তাঁর কাছে ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ সদৃশ। তাই আবু হাসান ভাইয়ের সাথে তাঁর পরিচয়োত্তর আমি দেখেছি বিয়ে বাড়িতে পুরো রাত তাঁরা পরস্পর গল্প করে কাটিয়েছিলেন। পরদিন সকালে তিনি সিলেট চলে যান। তখন তিনি সিলেট মেডিক্যাল কলেজে পড়তেন। প্রায় দুই বছরের (১৯৮১-১৯৮২) জন্য তাঁকে সিলেট মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হয়েছিল। মেজো ভাইয়ের সাথে তাঁর বেশ হৃদ্যতা ছিল, বয়সের দিক থেকেও খুব একটা ফারাক্ব ছিল না। মেডিক্যালে যাবার পূর্ব পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেলে তাঁর ঘোরাফেরার সাথী ছিলেন কয়েকজন। তন্মধ্যে মেজো ভাই সৈয়দ নূর আহমদ সাহেব, পীরের বাড়ির ভাগ্নে সৈয়দ এনামুল হক ও মরহুম সৈয়দ সদরুল আমীন সাহেব প্রমুখ। মাঝে মধ্যে তাঁর সাথে ভাগ্নে এডভোকেট সৈয়দ শায়েখ আহমদকে ও একসাথে বসে কথা বলতে দেখেছি তবে তিনি ও সে সময় ছাত্র ছিলেন বিধায় খুব একটা ঘোরাফেরা করতে দেখিনি।
ভাষাগত সমস্যা থাকা সত্যেও তিনি খুব সহজে সবার সাথে হাসিমুখে মিশতে পারতেন। বেশ সামাজিক ও বন্ধুবৎসল ছিলেন। তিনি একবার যার সাথে কিছু সময় বসতেন কথা বলতেন পরবর্তীতে সেই ব্যক্তির আপন হয়ে যেতেন। গুণগত কারণে আত্মীয় অনাত্মীয় সবাই তাঁকে ভালবাসত। উদাহরণ স্বরূপ বলছি তাঁর ইন্তেকালের কয়েকদিন পর লন্ডনে বসবাসরত আমার অগ্রজ আহমদ কুতুব ভাই সাহেব তাঁকে স্মৃতি চারণ করে চমৎকার একটা স্ট্যাটাস পোস্ট করেছিলেন। সেখানে দেখলাম তিনি আবু হাসান ভাইয়ের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও বংশীয় পরিচয় যৎকিঞ্চিৎ বর্ণনা করার পাশাপাশি তাঁর সাথে সামান্য ক’দিন ঘোরাফেরার স্মৃতি এবং তাঁর পরলোকগমণ যেন প্রচণ্ডভাবে অনুভব করেছেন। পরিশেষে আবেগময় ভাষায় আল্লাহ্ তায়ালার কাছে তাঁর জন্য মাগফিরাত ও জান্নাতে উচ্চাসন চেয়ে দুয়া করেছেন। তাঁর স্ট্যাটাসটির অভিনব প্রকাশভঙ্গি দেখেই বুঝা যায় ডাক্তার সৈয়দ আবু হাসান আত্মীয়তার সূত্রে ও একসাথে ঘোরাফেরার কারণে তাঁর বেশ কাছের একজন মানুষ ছিলেন।
১৯৮৬ সনে তিনি এম,বি,বি,এস সমাপ্ত করে মালয়েশিয়া প্রত্যাবর্তন করেন এবং তখন থেকেই তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। কয়েক বছর পর কর্মজীবনের ব্যস্ততা এড়িয়ে আবারো ইলেকট্রো মেডিসিনের উপর স্টাডি করার উদ্দেশ্যে তিনি আমেরিকার নেভাদা স্টেইটে পাড়ি জমান এবং সেখানে ইলেকট্রো মেডিসিনে বিশেষজ্ঞ হিসেবে সনদ লাভ করেন। মালয়েশিয়ায় তাঁর নিজস্ব প্রাইভেট ক্লিনিক ছিল। রোগীদের সেবায় তিনি ইলেকট্রো থেরাপি বা ইলেকট্রো মেডিসিন ফরমুলা ব্যবহার করতেন। কথা প্রসঙ্গে চিকিৎসার অভিনব পদ্ধতিসমূহ তিনি নিজেই আমার কাছে বর্ণনা করেছেন। বাংলাদেশ থেকে চলে যাবার পর আমাদের সাথে তেমন যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু চাচাজী (তাঁর পিতা হাফিজ সৈয়দ আবুল ফজল) এক দুই বছর অন্তর অন্তর শেখরের টানে দেশে আসতেন এবং সপ্তাহ দু এক অবস্থান করে আত্মীয় স্বজন সকলকে দেখে ফিরে যেতেন। চাচাজী সাধারণত দেশে আসলে যেকোনো ভাবেই হোক নিকটাত্মীয় সবাইকে অন্ততঃ একবারের মতো হলেও দেখার চেষ্টা করতেন। আমি ১৯৮৩ সনের অক্টোবর থেকে জুলাই ১৯৮৯ ইংরেজী পর্যন্ত প্রায় ছয় বছর সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছি। ঐ সময়টুকুতে যতবার তিনি বাংলাদেশে এসেছেন আমাকে বাড়িতে না পেলে মাদ্রাসায় এসে দেখে যেতেন। ১৯৯২ সনে একবার স্বল্প সময়ের জন্য এসেছিলেন বাংলাদেশে। তখন আমি সুনামগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় ছিলাম। সকল আত্মীয়ের সাথে দেখা সাক্ষাত শেষে আমার সাথে দেখা হয়নি বিধায় তিনি অনেক কষ্টে সুনামগঞ্জ চলে আসেন। পরিবারের সদস্যদের প্রতি, আত্মীয়দের প্রতি, জন্মভূমি বাংলাদেশের প্রতি চাচাজীর মনের টান ছিল প্রচণ্ড রকমের।
মে ১৯৯৬ সনে স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে আমি বিলেত চলে আসি। ১৯৯৭ সনের প্রথমদিকে মালয়েশিয়া থেকে চাচাজী, চাচি ও চাচাতো ভাই সৈয়দ আবু হুসেইন সহ তাঁরা তিনজন দশ বারো দিন সময় হাতে নিয়ে ইংল্যান্ড আমার বাসায় আসেন। আমি তখন সান্ডারল্যান্ড সিটির হেন্ডন মসজিদের ফ্লাটে পরিবার নিয়ে থাকতাম। সান্ডারল্যান্ড এমন একটি সিটি যেখানে বাংলাদেশী কমিউনিটির প্রায় শতকরা পচান্নব্বই ভাগ লোক সৈয়দপুর গ্রামের। এ হিসেবে আমাদের অসংখ্য নিকটাত্মীয় এই নগরীতেই বসবাস করেন। চাচাজীর সংবাদ শুনে তাদেরকে দেখার জন্য সব সময় আত্মীয়দের আনাগোনা ছিল অব্যাহত। ঐ সময়টা আমাদের কাছে কত যে ভাল লেগেছে এবং কেটেছে বলা বাহুল্য। বড় ভাই সাহেবের পরিবার তখনো ইংল্যান্ড আসা হয়নি বিধায় পুরো সময়টুকু তাঁরা আমার বাসায়ই থেকেছেন। এখানে থেকেই আত্মীয়দের বাসায় বেড়াতে যেতেন এবং অনেকে তাদেরকে বিভিন্ন সময় দাওয়াত ও খাইয়েছেন।
চাচাতো ভাই সৈয়দ আবু হুসেইন সাহেবের সাথে এই প্রথমবারের মতো আমাদের দেখা সাক্ষাত্ ও পরিচয় হয়, এর পূর্বে কখনও তাঁর সাথে আমাদের পরিবারের কারো দেখা সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি। ভাই বোন বারো জনের মধ্যে সৈয়দ আবু হুসেইন দ্বিতীয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে তিনি বি এ পাশ গ্র্যাজুয়েট। কর্মক্ষেত্রে একজন ধার্মিক শিল্পপতি ও রাজনীতিবিদ এবং বর্তমানে মালয়েশিয়ার সংসদ সদস্য। এ সফরে ইংল্যান্ডে বসবাসরত সকল আত্মীয়ের সাথে পরিচয় হয়ে তিনি বেশ উত্ফুল্ল ছিলেন এবং চাচাজীকে বলতেন বিলেতের মাটিতে যদি আমাদের এত আত্মীয় স্বজন থেকে থাকেন তাহলে বাংলাদেশে না জানি আরো কত খেশ্ কুটুম রয়েছেন। তাই চাচাজী তাদেরকে নিয়ে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পথে বাংলাদেশে আরো ক’দিন অবস্থান করে আত্মীয় স্বজন সকলের সাথে দেখা সাক্ষাত ও পরিচয় করিয়ে মালয়েশিয়া প্রত্যাবর্তন করেন। আলহামদুলিল্লাহ্, এরপর থেকে বছর দেড়েক অন্তর অন্তর সৈয়দ আবু হুসেইন কখনো একা আবার কখনো পরিবার নিয়ে আমাদেরকে দেখতে আসেন। সর্বশেষ তিনি সস্ত্রীক সংক্ষিপ্ত সফরে এসেছিলেন ফেব্রুয়ারি ২০১৯ আমার বড় ছেলের বিয়ে উপলক্ষে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ এর কারণে আর আসা হচ্ছে না।
১৯৯৭ সনের শেষের দিকে হঠাৎ একদিন ডাক্তার আবু হাসান ভাইয়ের ফোন কল। তিনি সস্ত্রীক লন্ডন এসেছেন, আমাদের লোকেশন দেওয়ার জন্য বললেন। তখনো আমার গাড়ি ছিল না। অতঃপর তিনি নিজেই ট্রেন যোগে নিউক্যাসল ট্রেন স্টেশন পর্যন্ত আসলেন এবং সেখান থেকে আমার সম্বন্ধী সৈয়দ আবু শ্যামাকে সাথে নিয়ে তাঁদেরকে নিয়ে এসেছিলাম। কয়েকদিন থাকলেন। কয়েক মাস পর কোন এক সুযোগে আবারো বেড়াতে আসলেন। একটা গাড়ি ভাড়া করে একদম লন্ডন থেকে সান্ডারল্যান্ড পর্যন্ত প্রায় তিনশ’ মাইল ড্রাইভ করে এসেছিলেন। তখন তো নেভিগেটর বা টমটম সিস্টেম ছিল না যে, গাইড করে নিয়ে আসবে। রোডম্যাপ ফলো করেই আসেন আর সহযোগী হিসেবে সঙ্গে স্ত্রী ও ছিলেন। তাঁদেরকে নিয়ে শহরের বিভিন্ন জায়গায় ও আত্মীয়স্বজনদের বাসায় ঘুরেছি। অবাঙালি পরিবেশে বেড়ে ওঠা ভাইদের আত্মীয়প্রেম দেখে কোন কোন সময় আমরা অনেকটা লজ্জাবোধ করতাম এই ভেবে যে, আমরা ইংল্যান্ডের মতো জায়গায় থেকে ও তাঁদের কাছে বেড়াতে যেতে পারি না, অথচ তাঁরা প্রাচ্যের দেশ সুদূর মালয়েশিয়া থেকে কত কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের দেখতে আসেন। মূলত রক্তের টানেই আসা হত। হয়তো আমরা আত্মীয়দের মাঝে বসবাস করায় এতটুকু অনুভব করতে পারিনা যতটুকু অনুভব করতে পারেন তাঁরা।
আমি ইংল্যান্ড আসার পর চাচাজী মালয়েশিয়া থেকে শুধুমাত্র একবারই এসেছিলেন যা ইতিমধ্যে বর্ণনা করেছি। তারপর অনেকবার অনুরোধ করেছি কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে আসেন নাই। এছাড়া আরেকটা কারণ ছিল – তিনি মনে করতেন ইংল্যান্ড সফরে গেলে কি জানি সেখানে মৃত্যু হয়ে যায় কিনা। তাঁর বাসনা ছিল মৃত্যু যেন মক্কা মদীনায় হয় কিম্বা নিজের জন্মভূমি বাংলাদেশে হয় নতুবা মালয়েশিয়া ছেলেমেয়েদের সাথে থেকে হয়। তাই তিনি বার্ধক্যের শেষ কয়েক বছর এ নিয়্যতে মক্কা মদীনা এবং বাংলাদেশ ঘন ঘন সফর করেছেন। কিন্তু এর বাইরে অন্য কোন দেশে সফর করেন নাই। বরং আমাদেরকে তাঁর কাছে বেড়াতে যেতে খুব চাপাচাপি করতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সময় সুযোগ করতে পারি নাই। ২০০১ সনের মাঝামাঝিতে ডাক্তার আবু হাসান ভাই যখন স্বল্প পরিসরে বেড়াতে আসেন তখন চাচাজী স্বর্ণের দোকান থেকে একটি আংটি কিনে তাঁর কাছে দিয়ে বললেন, “আমার কথা বলে এই আংটি ছাবির আহমদের স্ত্রীকে দিও। মনে হয় আমার জীবদ্দশায় তারা মালয়েশিয়া আসবে না।ʼʼ এই আংটি পেয়ে আমার স্ত্রী ও যারপরনাই খুশি, মহাখুশি। আজো চাচা শ্বশুরের প্রদত্ত হাদিয়াটি স্মৃতি স্বরূপ সযত্নে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। আমাদের এখানে আবু হাসান ভাইয়ের ২০০১ সনের সফরটাই ছিল শেষ সফর। এরপর আর আসা হয়নি।
১৯৯৮/১৯৯৯ সনের কোন একদিন মালয়েশিয়া থেকে আবু হাসান ভাইয়ের পাঠানো একটা পার্সেল পেলাম। পার্সেলের ভিতর দুটি মনিহার, বাঁশের তৈরি তালপাতার ফ্যানের ন্যায় কারুকার্য খচিত বড় আকারের ফ্যান্সি। আবার কালো ব্যাকগ্রাউন্ডের উপর সোনালী অক্ষরে ক্যালিগ্রাফি করে পুরো আয়াতুল কুরছি লেখা। যেকোনো রংয়ের দেয়ালে ডিসপ্লে করা হলে বেশ সুন্দর দেখায়। পার্সেলের ব্যাপারে টেলিফোনে আমাকে বললেন দুটি মনিহারের একটি তোমার জন্য আরেকটি তোমার মসজিদের জন্য। এই ফ্যান্সি জিনিসটি প্রায় একুশ বাইশ বছর পর ও আজ অবধি আমার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে এবং ফ্রন্ট রুমে শোভা পাচ্ছে। এর ছবিটাই আমি ব্যবহার করি আমার ফেবুর প্রফাইল আইকন হিসেবে। গত ১৯শে ডিসেম্বর ২০২০ইং শনিবার তিনি মহান আল্লাহর ডাকে চিরদিনের জন্য এ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। অথচ তাঁর রেখে যাওয়া স্মৃতি আজ বারবার চোখে পড়ে। অনেক সময় ভাবিয়ে তুলে, অনেক কিছু স্মরণ করিয়ে দেয়। কখনো বা মনের অজান্তেই আঁখিযুগল অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে। তখন প্রার্থনা করি, “ওগো দয়াময় আল্লাহ্! আমার এই ভাইকে ক্ষমা করে দাও। তাঁর ক্ববরকে বানিয়ে দাও জান্নাতের বাগান।ʼʼ
[নোটঃ আমাদের পরিবার পরিজন অনেকেরই অনেক স্মৃতি তাঁদের সাথে জড়িয়ে আছে। কিন্তু আমি ব্যাপকতায় না গিয়ে শুধুমাত্র আমার জায়গা থেকে যৎসামান্য স্মৃতিচারণ করেছি।]