সবাইকে বইটি পড়ার অনুরোধ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর: সাড়া জাগানো গ্রন্থ ‘স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ‘র আন্তর্জাতিক ভার্চুয়াল প্রকাশনা উৎসব
|| সুরমা প্রতিবেদন ||
লণ্ডন, ২০ নভেম্বর – বাংলাদেশের প্রখ্যাত রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক পিনাকী ভট্টাচার্যের সাড়াজাগানো গ্রন্থ ‘স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ’-এর আন্তর্জাতিক ভার্চুয়াল প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ১৫ নভেম্বর, রোববার।
প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে ঢাকা থেকে অনলাইনে যোগ দিয়েছিলেন এই মুহূর্তে সবচাইতে প্রোজ্জ্বল মুক্তিযোদ্ধা জীবন্ত কিংবদন্তি গণস্বাস্থ্য খ্যাত ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী। পশ্চিম ইউরোপে বাংলাদেশের অন্যতম খ্যাতিমান সাংবাদিক ও বর্তমানে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক সুরমার সম্পাদক শামসুল আলম লিটনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত প্রকাশনা উৎসবে ফ্রান্স থেকে লেখক পিনাকী ভট্টাচার্য, বইয়ের প্রকাশক হরপ্পা প্রকাশনীর কর্ণধার ও বিশিষ্ট কবি আহমদ ময়েজ, বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদের পুত্র বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সৈয়দ মামনুন মোর্শেদ, সাবেক সচিব ড. কামাল সিদ্দিকী, ঢাকা থেকে ডাকসুর সাবেক ভিপি নূরুল হক নূর, বিএনপি নেতা জহির উদ্দিন স্বপন, সাপ্তাহিক জয়যাত্রা সম্পাদক ও গণস্বাস্থ্যের তথ্য উপদেষ্টা জাহাঙ্গির আলম মিন্টু, কানাডার মন্ট্রিয়েল থেকে নাগরিক টিভির প্রধান নির্বাহী মোস্তাফিজুর রহমান টিটো, মালয়েশিয়ার মাশা ইউনিভার্সিটির মেডিক্যাল ফেকাল্টির প্রফেসর মেজর (অব.) ড. আবুল বাশার, সিঙ্গাপুর থেকে বিশিষ্ট কলামিস্ট মিনার রশিদ, সাপ্তাহিক সুরমার ডিরেক্টর এমদাদুর রহমান, সহ আরো অনেকে। উত্তর আমেরিকার বাংলা চ্যানেল ‘নাগরিক টিভি’ এবং লণ্ডনে জনপ্রিয় এলটিভি বাংলার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ওই সম্প্রচারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শতাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও পাঠকবৃন্দ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ভার্চুয়াল মাধ্যমে যোগ দেন।
অনুষ্ঠানে লেখক পিনাকী বইটি লেখার উদ্দেশ্যে একসময় ড. জাফরুল্লাহর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বলে জানান। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে একদিন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর হেলিকপ্টারে গুলি করা হলো। ওইদিন ছিলো ১৩ ডিসেম্বর বিকাল। মুক্ত হয়েছে কুমিল্লা। একটি এনএইট হেলিকপ্টারে তাঁরা কুমিল্লায় পৌঁছান। শেখ কামাল সাথে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী, শেখ কামাল, ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং মুক্তিবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল এমএ রব। বিশ্রামের জন্য কুমিল্লার সার্কিট হাউজে পৌঁছে সবাই হতবম্ব। ওসমানী সাহেবকে হাত বাড়িয়ে কুমিল্লায় রিসিভ করছেন কয়েকজন ভারতীয় বাঙালী। একে একে তারা পরিচয় দিলেন, আমি মুখার্জী আইএসএস, আমি গাঙ্গুলী আইপিএস’। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে তারা এখানে পৌঁছেছেন কুমিল্লা মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। তারা শহরের আইন শৃংখলা রক্ষার নিরাপত্তার সমন্বয় করবেন। তারপর শেখ কামাল ড. জাফরুল্লাহকে বলেন, জাফর ভাই আপনি ওসমানীকে সাহেবকে বলেন আজকেতো আতœসমর্পন অনুষ্ঠান হবে আপনি রমনা পার্কে যান। শেখ কামাল সরাসরি জেনারেল ওসমানীকে বলার সাহস পাচ্ছিলেন না ,তাই জাফরুল্লাহকে দিয়ে বলাচ্ছিলেন। কিন্তু জেনারেল ওসমানী সিলেট যেতে চান। তখন হেলিকপ্টার রওয়ানা দিবে এমন সময় একটি প্লেন এসে হেলিকপ্টারের চারিদিকে চক্কর দিলো। তার পরপরই একটি বিস্ফোরণ। সাথে সাথে জেনারেল রব আর্তনাদ করে উঠলেন, কারন তার পায়ে গুলি লেগেছে এবং সাথে সাথে হার্টঅ্যাটাক হয়েছে। হেলিকপ্টারের গুলি লেগে তেল বের হয়ে যাচ্ছে। পাইলট কাউন্ট ডাউন সময় গুণছে। তিনি ছিলেন উদ্বিগ্ন। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে যিনি সহকারী পাইলট ছিলেন তিনি খুব ধীর স্থিরভাবে বসে ছিলেন, যেনো কিছুই হয়নি। তখন জেনারেল ওসমানী সবাইকে অভয় দিয়ে বলেন, ভয় পেওনা বাছারা। সিলেটকে আমি হাতের তালুর মতো চিনি।
পিনাকী আরো বলেন, ওই ঘটনা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, সেই প্লেনটা কাদের ছিলো? কারা সবাইকে মারার জন্য ওই প্লেন পাঠিয়েছিলো? উড্ডয়নের মতো কোনো বিমান পাকিস্তানের ছিলো না। সব বিমান বন্দর ছিলো ধ্বংস করা। ওই বিমান অবশ্যই ভারতীয় সেনাবাহিনীর এবং ওটা গুয়াহাটির দিক থেকে আসছিলো। গুয়াহাটি থেকে এসে যে গুলি করলো ওই গুলিটা প্রাণ বিধ্বংসী হতে পারতো। ওই দিন জেনারেল ওসমানীসহ অনেকেই মারা যেতে পারতো। ওই ঘটনার মতো আরো হাজারো ঘটনা আছে। এতো বড় একটা ঘটনা যা আমাদের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। যা আমাদের নতুন প্রজন্মকে জানানো হচ্ছে না। এটা স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশিদের জানা দরকার। এই ইতিহাসের মীমাংসা করা দরকার।
অনুষ্ঠানে ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, পিনাকী যে ঘটনার কথা বললেন এটা আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের জন্য অনেক বড় ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনার কথা ভারতের কোথাও প্রকাশ হলো না। আমাদের স্বাধীনতার ১৬ খ-ে নেই এই ঘটনার কথা। এই ঘটনা কোথাও না থাকা প্রমাণ করে কিভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গুলিয়ে ফেলা হয়। পিনাকীর বইটা যখন পড়ি তখন মনে হচ্ছিল আমি মুক্তিযুদ্ধের মাঠে আছি। যেদিন বাংলাদেশ হানাদার মুক্ত হচ্ছে সেদিন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের হেলিকপ্টারে হামলা হলো, কারা করলো সেটা কেন কোনো গ্রন্থে নেই? সেই ইতিহাসকে কেন লুকিয়ে রাখা হয়েছে, এসব প্রশ্নের উত্তর বের করতে হবে। এটাই স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাস। এই ইতিহাস এই প্রজন্মের নাগরিকদের জানার ব্যবস্থা করতে হবে। পিনাকীর এই বইটি ইতিহাসের বিভিন্ন দিক থেকে আলোচনা করা হয়েছে। সবাইকে বইটি পড়ার অনুরোধ করেন ডা. জাফরুল্লাহ।
ডাকসু’র সাবেক ভিপি নূরুল হক নূর বলেন, আমরা এখন শুধু দেবতা আর দেবত্বের গল্প শুনি। কিন্তু বাংলাদেশ এতো রক্ত আর আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীন হলেও কেন আমরা একটা মানবিক রাষ্ট্র পাইনি, রাজনীতিকরা কেন এতো ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হয়েছেন, এটা আমাদের অবশ্যই জানতে হবে । তাহলে আগামীদিনে মানবিক ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আমরা সক্ষম হবো। কারো প্রতি আমাদের অনুরাগ আর নয় বরং ইতিহাস আপনাদের অর্জন আর করবে। তিনি বলেন যেই দেশে এইরকম গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ হতে পারে না, যেখানে লেখক গবেষক পিনাকী ভট্টাচার্যরা লেখার জন্য দেশান্তরী হতে হয়, সেখানে গণতন্ত্র আর বড়াই জনগণের সঙ্গে একটা উপহাস ছাড়া আর কিছুই নয় ।
মিনার রশীদ বলেন, রাজনীতিকদের কাছ থেকে আমরা ইতিহাসের নামে যা শুনি তা আসলে দলীয় প্রোপাগা-া। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের উপর লেখা এই গ্রন্থ সেসব প্রোপাগা-া’কে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে। এই কারণে প্রকাশের আগেই ফ্যাসিবাদী শক্তি এই বইকে টার্গেট করেছে। তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না হিটলার ইতিহাসে নায়ক হতে গিয়ে জঘণ্যতম ভিলেন হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। ইতিহাস বড় নির্মম।
মোস্তাফিজুর রহমান টিটু বলেন, পিনাকী ভট্টাচার্য তথ্য উপাত্তের বাইরে কখনো যান না। যারা তথ্যকে ভয় পায় তারাই এই বইটিকে ভয় পাবে। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। এই গ্রন্থটি বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম প্রধান প্রামাণ্য দলিল হিসেবে সকল গবেষণায় ব্যবহৃত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সাপ্তাহিক সুরমার পরিচালক এমাদুর রহমান বলেন, নতুন প্রজন্মের একজন বাংলাদেশী হিসেবে আমরা লেখক পিনাকী ভট্টাচার্য এর কাছে ঋণী হয়ে গেলাম। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পরে জন্ম হবার কারণে আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, স্বাধীনতার প্রথম কয়েক বছরে কি ঘটেছিল সেটা ও দেখিনি, কেবল মানুষের মুখে শুনেছি। এই বই পড়ে আমরা একই সাথে বিস্মিত ও শিহরিত, কারণ ঘটনাগুলো যে আসলে এইরূপ ছিল তা আমাদের ধারণারও বাইরে। বাংলাদেশের ইতিহাসের নানা বাঁক বদলের কথা দুই মলাটে তুলে আনার জন্য যারাই বই লিখেছেন, খুব অল্পসংখ্যক ব্যতিক্রম বাদে তাদের প্রায় সবাই কোনো একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে মহীয়ান করে তোলার চেষ্টা করেছেন। এইসব বই পড়লে মনে হবে মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে বাংলাদেশে তৎকালীন কোনো মানব নেতৃত্ব ছিল না, বরং স্বর্গ থেকে কতপয় দেবদূত এসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বিশেষ করে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভের দিন থেকে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ইতিহাসের এই অংশটুকু নিয়ে আছে চরম বিতর্ক। ও সময়ের নির্মোহ ও নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণের তথ্য ও উপাত্তভিত্তিক নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণ্য গ্রন্থ নতুন প্রজন্ম এখনো হাতে পায়নি। অথচ দেশকে বোঝার জন্য, দেশের মানুষের আগামীকাল পরিণতি বোঝার জন্য এবং ইতিহাসের বাঁকবদলের গতিমুখ বোঝার জন্য ওই সময়কার নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাস পাঠ অতীব জরুরী
প্রকাশকের বক্তব্য:
প্রাশনা উৎসবে বইয়ের প্রকাশক হরপ্পা প্রকাশনীর কর্ণধার ও বিশিষ্ট কবি আহমদ ময়েজ বইটি প্রকাশনার আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন। তিনি জানান যখন তিনি জানতে পারেন বাংলাদেশে বইটি প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না এবং লেখক প্রাণভয়ে ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন, তখন তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন এর মধ্যে হয়তো বিতর্কিত কোনো রাজনৈতিক উপাদান থাকতে পারে। কিন্তু তিনি পাণ্ডুলিপিটি পড়ে দেখলেন অত্যন্ত যুক্তি সহকারে ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তসহ যেসব বর্ণনা বইটিতে দেওয়া আছে তা বাংলাদেশের একটা বিশেষ সময়ের অনেক অজানা দিক জনসাধারণের কাছে উন্মোচিত করবে। সবচাইতে বড় কথা হলো বইতে কাউকে অযাচিত হিরো কিংবা জিরো বানানো হয়নি। বইটি পড়লে যে কেউ বুঝবেন লেখক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি অত্যন্ত সম্মানের স্থান থেকে দেখেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সফল স্থপতি হবার পরেও দেশ পরিচালনায় তিনি যেসব অনভিজ্ঞতা জনিত ভুলত্রুটি করেছিলেন তার দিকে বেদনার্ত সহমর্মিতায় আলোকপাত করেছেন। বইটির পাণ্ডুলিপি পড়েই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই বইয়ের বক্তব্য মানুষের কাছে যাওয়া উচিত, জনগণের সত্য জানার অধিকার আছে, ইতিহাসের ধুলো কাদা থেকে বেরিয়ে আসা সত্য জানার পরে জনগণ নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে কাকে কতটুকু উঁচু বা মধ্যম মানের স্থান দেবে।
এছাড়াও অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা থেকে বিপ্লবী ওয়র্কার্স পার্টির নেতা সাইফুল হক, লণ্ডনে সাপ্তাহিক সুরমার প্রধান সম্পাদক কবি ও কলামিস্ট ফরীদ আহমদ রেজা, বার্তা সম্পাদক কবি কাইয়ূম আবদুল্লাহ, লেখক -গবেষক আসিফ আরমানি, সাংবাদিক মোহাম্মদ হাসনাত খান প্রমুখ।
বইটির প্রকাশনা উৎসব রোববার অনুষ্ঠিত হলেও এর আগে গত ২৯ অক্টোবর ফ্রান্স থেকে প্রকাশনা সংস্থা হরপ্পার লণ্ডন কার্যালয়ে অনলাইনে যুক্ত হয়ে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেছিলেন স্বয়ং লেখক পিনাকী ভট্টাচার্য। লণ্ডনের সুবিখ্যাত বাংলা প্রকাশনী হরপ্পা থেকে বের হওয়া ইউরোপে মুদ্রিত ও বাধাইকৃত ৪৬২ পৃষ্ঠার এই হার্ডকভার বইয়ের দাম ধরা হয়েছে ব্রিটিশ মুদ্রায় ২০ পাউণ্ড।