স্মৃতি অমলিন: মেজর এম এ জলিল

[২০ নভেম্বর, মুক্তিযুদ্ধে ৯নং সেক্টর কমাণ্ডার মেজ এম এ জলিলের মৃত্যুদিবস। একজন মহান রাজনীতিবিদ ছাড়াও তিনি ছিলেন শক্তিমান লেখক। তিনি উচ্চারণ করেছিলেলন ‘অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা’। এর মর্মার্থ জাতি আজও প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছে। বেদনার কথা, এই মহানমযুক্তিযুদ্ধা স্বাধীন বাংলার প্রথম রাজবন্দী — যাকে তৎকালীন সরকার দীর্ঘ দিন কারা বন্দী করে রেখেছিল এই মর্মে যে তিনি আদিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, ছিলেন আপোষহীন। এই বীরমুক্তিযোদ্ধার উপর স্মৃতিচারণমূলক একটি লেখা—’স্মৃতি অমলিন: মেজর এম এ জলিল’ যা সুরমার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
লিখেছন— মোহাম্মদ শাহ আলম}
মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টর কমাণ্ডার। জন্ম ১৯৪২ বরিশালের উজিরপুর। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। সেনাবাহিনীতে চাকুরীকালে ব্যাচেলর ডিগ্রী এবং ইতিহাস বিষয়ে এমএ ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৬৫ সালে ক্যাপ্টেন এবং ১৯৭০ সালে মেজর পদে উন্নীত হন। ৭১ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে মুলতান থেকে ছুটিতে আসেন বরিশালের গ্রামের বাড়িতে। দেশের টালমাটাল পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পেরে চাকুরিতে যোগদানের জন্য মুলতানে ফিরে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। মার্চ মাসের ২৬ তারিখে মেজর জিয়ার কন্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং নবম সেক্টরে কমাণ্ডার নিযুক্ত হন।
১৬ ডিসেম্বরের বিজয় লগ্নে মিত্র(?) বাহিনীর আচরণে জলিলের কাছে অধিক স্পষ্ট হয়ে উঠে মুক্তি বাহিনীকে সাহায্যের পেছনে বন্ধু রাষ্ট্রের দুর্মতলব। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জে. আতাউল গণি ওসমানীকে কৌশলে অনুপস্থিত রেখে ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ণ কমাণ্ডের প্রধান সেনাপতি লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করানো হয় লে. জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ্ নিয়াজীকে। একইভাবে ১৭ ডিসেম্বর খুলনার সার্কিট হাউস ময়দানে ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণ সেক্টর প্রধান হিসেবে মেজর জলিলের কাছে না হয়ে এই আত্মসমর্পণ করানো হয় ভারতীয় সেনা অফিসার মেজর জেনারেল দানবীর সিং এর কাছে। ঢাকার রমনা রেসকোর্সের ময়দানে ওসমানীকে পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কৌশলে অনুপস্থিত রাখা হলেও, খুলনার সার্কিট হাউস মাঠে সেক্টর কমাণ্ডার জলিল উপস্থিত ছিলেন। সেক্টর কমাণ্ডারের এই অবমাননা ও উপেক্ষা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একজন সেনা কমাণ্ডার হিসেবে জলিল সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। স্বাভাবিকভাবেই এটা প্রত্যাশিত ছিলো যে পাকিস্তান বাহিনী সেক্টর কমাণ্ডারের কাছেই আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু, কার্যত আত্মসমর্পণ করানো হলো ভারতীয় একজন সেনা কমাণ্ডারের কাছে। ফলে মেজর জলিলের আগে থেকে জ্বলতে থাকা ক্ষোভের আগুন তীব্রতর হয়।
মুক্ত বাংলাদেশে জলিল দেখতে পেলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বাংলাদেশের সম্পদ ভারতীয় বাহিনী লুট করছে এবং সীমান্তপারে চালান করছে। জলিল ভারতীয় সেনাদের এ হেন লুন্ঠনের প্রতিবাদ জানিয়ে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী এবং ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের সর্বাধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে চিঠি লিখেন। এই চিঠিগুলো যথারীতি তাঁদের কাছে পৌছানো হয়।
মিত্র(?) বাহিনীর লুট ও সীমান্তের দিকে চালান এই চিঠির পরেও অব্যাহত থাকলে ভারতীয় বাহিনীর বেপরোয়া লুটতরাজ এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মিত্র(?) বাহিনীর নানা আচরণ, যা জলিলের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছিলো, সে সাথে আত্মসমর্পণের এই দুটি ঘটনা জলিলের ক্রোধের আগুনে বারুদ ঢেলে দেয়। মেজর জলিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল দানবীর সিংকে বলে দেন, “দেখা মাত্র গুলির হুকুম দিয়েছি আমি, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে লুটতরাজ করা হতে বিরত রাখুন।”
পরবর্তী কয়েক দিন তিনি জলজাহাজে চড়ে বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর এবং ভোলার বিভিন্ন জায়গায় জনসভা করে জনসাধারণকে ভারতীয় বাহিনীর লুটতরাজ সম্পর্কে সতর্ক করে দেন, এবং প্রয়োজনে প্রতিরোধের আহ্বান জানান। এক পর্যায়ে তিনি সরাসরি প্রতিরোধ করেন এবং দুই পক্ষে গোলা বিনিময়ও হয় বলে প্রচার আছে। এভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক লুন্ঠনের প্রতিবাদ করায় ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বরে বন্দী করে যশোর সেনা ছাউনির একটি নির্জন, সেঁতসেঁতে, ঘুটঘুটে অন্ধকার কক্ষে আটক রাখা হয়, এবং পৌষ-মাঘের শীতে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয় ছেঁড়া ময়লা কম্বল সেক্টর কমাণ্ডার মেজর এম এ জলিলকে। একই সাথে তাঁকে সেক্টর কমাণ্ডারের পদ থেকেও চ্যুত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এ সব তথ্য জানা যায় মেজর জলিলের নিজের জবানীতে।
গ্রেফতারের কারণ হিসেবে বলা হয় মিত্র বাহিনীর প্রতি জলিল গর্হিত আচরণ করেছেন। এভাবে মেজর জলিলকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দীর অলঙ্কারে “ভূষিত” করা হয়। সরকার তাঁকে গ্রেফতার করেই ক্ষান্ত হয়নি। সকল সেক্টর কমাণ্ডারকে বীরোত্তম পদকে ভূষিত করা হলেও ৯ নম্বর সেক্টর কমাণ্ডার মেজর জলিলকে দেওয়া হয়নি কোন বীরত্বসূচক পদক।
মেজর জলিলের মুক্তির দাবী জানিয়ে তাঁর বৃদ্ধ বিধবা মা তৎকালিন রাষ্ট্র/সরকারপ্রধানের কাছে খোলা চিঠি লেখেন। ছয় মাস পর মেজর জলিল বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পান এবং ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে অা স ম আবদুর রব, সিরাজুল আলম খান, শাহজাহান সিরাজ, শরিফ নুরুল আম্বিয়া, আরিফ আহমদ, মমতাজ বেগম, বিধান কৃষ্ণ সেন সহ মুজিব সরকার এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাথে ভিন্ন মত পোষণকারী, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী অন্যান্য তরুণ ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠন করেন। এ বছরেরই ডিসেম্বর মাসে দলের প্রথম কাউন্সিলে তিনি দলের সভাপতি নিযুক্ত হন এবং আ স ম আবদুর রব সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। জাসদের লক্ষ্য ছিলো “বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র” কায়েম করা।
প্রতিষ্ঠার পাঁচ মাসের মাথায় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে তারা ২৩৭টি আসনে প্রার্থী দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনের আগেই বিভিন্ন স্থানে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে। তারা বিরোধী দলের অনেক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিলেও বাধা দেয়। বেশ কিছু আসনে বিরোধী দলের জয়ী প্রার্থীকে হারিয়ে দেওয়া হয়। দাউদকান্দিতে জাসদ প্রার্থী আবদুর রশীদ ইঞ্জিনিয়ারের কাছে খন্দকার মোশতাক আহমদ হেরে গিয়েছিলেন। কিন্তু হেলিকপ্টারে করে ভোটের বাক্স ঢাকায় এনে তাঁকে জিতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে।
দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি এবং সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর গুম, হত্যা, নিপূগনের প্রতিবাদে ১৯৭৪ সালে ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও কালে গ্রেফতার হন মেজর জলিল জাসদের অপরাপর নেতৃবৃন্দের সাথে। ৭৫ সালের ৮ নভেম্বর মুক্তি পান। ২৫ নভেম্বর আবার গ্রেফতার হন। ১৯৮০ সালে মুক্তি পেয়ে ৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়েন ত্রিদলীয় জোটের মনোনীত প্রার্থী হয়ে। ইশতেহারের মূল এজেণ্ডা ছিলো পেশাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব সহ ৫০০ আসনের পার্লামেন্ট এবং দেশকে ৮ প্রদেশে বিভক্ত করে কেন্দ্রিভূত ক্ষমতার প্রশাসনের বিলুপ্তি।
১৯৮৪ সালে জাসদের সাথে বিচ্ছেদ:
১৯৮৪ সালের ৩ নভেম্বর জাসদ থেকে পদত্যাগ করে বাম রাজনীতির যাবনিকা টানেন। জাসদ থেকে পদত্যাগ করার মাত্র ১৬ দিন পর তিনি “জাতীয় মুক্তি আন্দোলন” নামে একটি ইসলামী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে তিনি হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বে ইসলামী দলগুলোর সাথে দশ দলীয় জোটের “সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ” (মজলিশে মোশতারাকা আমল) গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। জাতীয় মুক্তি আন্দোলন গঠনের পর লেবানন, যুক্তরাজ্য, লিবিয়া, পাকিস্তান ও ইরানে বেশ কয়েকটি ইসলামী সেমিনার ও সম্মেলনে যোগ দেন। তাঁর মৃত্যুও হয় পাকিস্তানে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগ দিতে গিয়ে ইসলামাবাদে।
এরশাদ সরকারের দুর্নীতি ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় ১৯৮৫ সালের জানুয়ারী মাসে তাকে একমাসের জন্য গৃহবন্দী করে রাখা হয় একবার এবং ১৯৮৭ সালের শেষ দিকে দ্বিতীয়বার প্রায় তিনমাস কেন্দ্রীয় কারাগারের আটক রাখা হয়।